মানসিক চাপের কারণে পারিবারিক সম্পর্ক প্রভাবিত হয়।এটি যেকোনো সময়ই ঘটতে পারে। তবে করোনাকালীন সময়ে এর প্রভাব আরো বেশি। মানসিক চাপের কারণে অনেকসময় পরিবারের কোনো সদস্য এমন নিপীড়নমূলক আচরণ করে বসেন যা পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য অনিরাপদ। একেই বলা হয় পারিবারিক বা ঘরোয়া সহিংসতা। ঘরোয়া সহিংসতা বিভিন্ন রকম হতে পারে। এর মধ্যে শারীরিক ও যৌন নিপীড়নও অন্তর্ভুক্ত। তবে সব ঘরোয়া সহিংসতাই শারীরিক হয় এমনটিও নয়।
মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, আর্থিক টানাপোড়েন, পারিবারিক বা ধর্মীয় অধিকার বিষয়ক নিপীড়নও ঘরোয়া সহিংসতা হতে পারে। বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায়, আমাদের সমাজে ঘরোয়া বা পারিবারিক সহিংসতা নিয়ে তেমন আলোচনা করা হয় না। তারা ব্যাপারগুলো নিজেদের মধ্যে লুকিয়ে রাখে এবং মনে করে সময়ের সাথে সাথে এটি সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু এই ধারণা ঠিক নয়। এতে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা, বিশেষত নারী ও শিশুরা অনিরাপদ থেকে যায়।
পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের উপর নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতেই অনেক সময় সহিংসতার সূচনা হয়। এক্ষেত্রে অন্যের মতামতকে গুরুত্ব না দেওয়া, অন্যের বিশ্বাসের প্রতি অশ্রদ্ধা, নারীদেকে অবমূল্যায়ন করা এসবই অন্যতম কারণ। তাছাড়া মানসিক অবসাদ, পরিবারের কোনো অনিশ্চিত অবস্থা ও আর্থিক টানাপোড়েন সহিংসতার কারণ হতে পারে। ঘরোয়া বা পারিবারিক সহিংসতা একটি অপরাধ এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন। ঘরোয়া সহিংসতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারী ও শিশুদের সাথে ঘটে৷ শিশুরা ঘরোয়া সহিংসতায় চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এমন কি তারা সরাসরি সেই সহিংসতার শিকার না হলেও, এর ফলে শিশুদের মানসিক সুস্থতা প্রভাবিত হয়, যেমন উদ্বেগ, মানসিক চাপ এবং দীর্ঘমেয়াদী সহিংস আচরণকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা। যদিও সব পুরুষই সহিংস নয়, তবে পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে ঘরোয়া সহিংসতার অধিকাংশ অপরাধীই পুরুষ – স্বামী, পিতা বা পরিবারের অন্যান্য সদস্য।
করোনাকালীন লকডাউনের মধ্যে বেড়েই চলেছে পারিবারিক বা ঘরোয়া সহিংসতা। গত ২৬ মার্চ থেকে ১২ এপ্রিলের মধ্যে, জাতীয় জরুরি হেল্পলাইনে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা সম্পর্কিত ৭৬৯টি ফোন কল এসেছে, যা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় বাংলাদেশের ৬৪ টি জেলার মধ্যে ২৭ টি জেলায় কমপক্ষে ৪২৪৯ জন নারী এবং ৪৫৬ জন শিশু ঘরোয়া সহিংসতার স্বীকার হয়েছে। এর মধ্যে ১৬৭২ জন নারী এবং ৪২৪ জন শিশু প্রথমবারের মতো ঘরোয়া সহিংসতার স্বীকার হয়েছে। ভিকটিমরা লক ডাউনকে তাদের এই অবস্থার জন্য দায়ী করেছেন। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা তাদের চাকরি হারানো বা অর্থনৈতিক সংকটের কারণে হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ছেন। এক্ষেত্রে অনেকেই তাদের স্ত্রীসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের উপর নির্যাতন ও ঘরোয়া সহিংসতার ঘটনা ঘটাচ্ছেন।
বাংলাদেশের পাশাপাশি পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এই সমস্যা দেখা গেছে। গবেষকরা বলছেন, যেহেতু জরুরী অবস্থার সময় সবাই ঘরে অবস্থান করছেন তাই নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা বৃদ্ধির এই ঘটনা ঘটেছে। এ ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের ওয়েবসাইটে মন্তব্য করেছে, “যদিও ডেটা এখনও খুব কম। তবে চীন, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশ থেকে প্রাপ্ত প্রতিবেদনগুলি থেকে ধারণা করা হচ্ছে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে ঘরোয়া সহিংসতার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। হুবেই প্রদেশের জিংজহু শহরে একটি পুলিশ স্টেশনে রিপোর্ট হওয়া ঘরোয়া সহিংসতার সংখ্যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনগুণ বেড়েছ।”
সংস্থাটি কোভিড-১৯ এর ফলে নারীর প্রতি সহিংসতা বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য কারণের কথা উল্লেখ করেছে। এসবের মধ্যে প্রাথমিক কারণ হিসেবে মানসিক চাপ, সামাজিক ও প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থার ঘাটতি, পরিষেবাগুলি গ্রহণের সুযোগ হ্রাস, সামাজিক বিচ্ছিন্নতার ফলে বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ হ্রাস প্রভৃতি নারীদের প্রতি সহিংসতার ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়া বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ফ্রান্সে ঘরোয়া সহিংসতার ঘটনা এই সময়ে ৩০% বেড়েছে। তবে এর প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। সাইপ্রাস ও সিঙ্গাপুরের ঘরোয়া নির্যাতনের হেল্পলাইনে কলের সংখ্যা প্রায় এক তৃতীয়াংশ বেড়েছে। আর্জেন্টিনায় ঘরোয়া সহিংসতা সম্পর্কিত জরুরি পরিষেবাগুলিতে যোগাযোগ ২৫% বেড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম গার্হস্থ্য নির্যাতন দাতব্য সংস্থা রিফিউজ তার হেল্পলাইনে একদিনে ৭০০% কল বৃদ্ধির কথা জানিয়েছে।
ঘরোয়া সহিংসতা কমাতে এবং সমাধান করতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। সবার আগে পরিবার থেকেই সচেতনতা বৃদ্ধি করা – নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, অন্যের মতামত ও বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, সব পরিস্থিতিতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা ইত্যাদি। এছাড়া সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সহিংসতার অপরাধ বিষয়ক আইন এবং পরিসেবাগুলো আরো কার্যকরভাবে আরোপ করা। এতে অপরাধী শাস্তির সম্মুখীন হবে এবং ভিকটিমদেরও ভোগান্তি কমবে। করোনা মহামারীতে এই অবস্থা যেন আরো অবনতির দিকে না যায় সেই লক্ষ্যে ব্যক্তিগত ওসামাজিকভাবেও কিছু ব্যাবস্থা গ্রহন করা যায়।
বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যদি কর্মীদের ঘরে বসে কাজ করার সুযোগ করে দেয় এবং অনলাইন ভিত্তিক কাজের প্লাটফর্ম তৈরি করা যায় তাহলে দেশের একটি বড় অংশ করোনা কালীন আর্থিক সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে। তাছাড়া শিশুদের মানসিক বিকাশ অব্যাহত রাখতে ঘরোয়া খেলাধুলা, বই পড়া, কবিতা পড়া, সঙ্গীত চর্চা ইত্যাদি ভালো অভ্যাস তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করা। এতে করে তারা লকডাউনের সময়টি আনন্দের সাথে কাটাতে পারবে এবং সুস্হ বিকাশও অব্যাহত থাকবে।
সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ
৪৮ তম আবর্তন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বিষয়টি নিয়ে আলোচনা