বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে ঋতুপর্ণ ঘোষ শুধুমাত্র একটি নাম নয়। তিনি তার অসামান্য কাজের মাধ্যমে নিজ কাজকে একটি ব্র্যান্ড এ রূপান্তরিত করেছেন। বাংলা চলচ্চিত্র জগতে তাঁকে অনেকে “সত্যজিতের উত্তরসূরী ” কিংবা “হীরের আংটি” বলে সম্বোধন করেন। তাঁর প্রায় প্রতিটি ছবিতেই তিনি নারীদের মনস্তাত্ত্বিক বিষয় তুলে ধরেছেন। অনেক চরিত্রের ভীড়ে নারীদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য তার কাজে বার বার ধরা পড়েছে। তিনি নারীদের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা তাঁর শৈল্পিক দৃষ্টিতে সিনেমায় ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর কাজে রাবিন্দ্রিক একটা ব্যাপার সবসময়ই থাকে। ঋতুপর্ণের চলচ্চিত্র পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যায় তিনি রবীন্দ্রনাথ এর সৃষ্টিকে গুলে খেয়েছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ এর অনেক সৃষ্টিও রূপালী পর্দায় তুলে ধরেছেন। এমনকি তিনি তার দ্বিতীয় ছবি “উনিশে এপ্রিল ” নামকরণ করেন রবীন্দ্রনাথ এর বৌদি কাদম্বরী দেবীর সুইসাইডের তারিখের সাথে মিল রেখেই।
২০১২ সালে তিনি “জীবনস্মৃতি” নামে রবীন্দ্রনাথ এর জীবনীভিত্তিক তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। এছাড়াও ২০০৩ সালে নির্মাণ করেন রবীন্দ্রনাথ এর বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে “চোখের বালি ” সিনেমা। তত দিনে বাঙালি দর্শক বুঝে গিয়েছে সিনেমার রূপালী জগতকে ঋতুপর্ণ অনেক কিছু দিয়ে যাবেন। তিনি বাঙালি দর্শকদের হতাশ করেননি। তারপর ২০১০ সালে নির্মাণ করেন রবীন্দ্রনাথ এর আরেকটি উপন্যাস অবলম্বনে “নৌকাডুবি” সিনেমা। তাছাড়া প্রায় প্রতিটি সিনেমাতেই রবীন্দ্রনাথ এর গান, কবিতা, বিভিন্ন ছোটগল্পের উদাহরণ এমন শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করেছেন যে দর্শকরা ধরেই নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ঋতুপর্ণকে ঘিরে ধরেছে। সত্যিই ঋতুপর্ণের কাজে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব কোনো ভাবেই অস্বীকার করা যায় না। তাঁর সৃষ্টির অধিকাংশ জুড়েই রয়েছে রাবিন্দ্রিক স্পর্শ।
শরৎচন্দ্র তাঁর উপন্যাসে নারীদের প্রধান চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, ঠিক তেমনি ঋতুপর্ণও হাল আমলের নারীদের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো তাঁর কাজে ফুটিয়ে তুলেছেন। এদিক দিয়ে শরৎচন্দ্রের সাথে ঋতুপর্ণের বেশ মিল খুঁজে পাই। শরৎচন্দ্রের “মেজদিদি ” উপন্যাসে হেমাঙ্গিনীকে লেখক উপস্থাপন করেছেন মমতাময়ী একজন নারী রূপে; সমস্ত উপন্যাস জুড়েই ছিল হেমাঙ্গিনীর আধিপত্য। তাছাড়া “বড়দিদির” মাধবীকে ঘিরেই লেখক উপন্যাসের পটভূমি রচনা করেছেন। শরৎচন্দ্রের সৃষ্টিতে তাঁর আমলের নারীদের শোষণ-নিপীড়নের প্রতিবাদী চিত্র এঁকেছেন তাঁর সৃষ্টির নারী চরিত্রের মাধ্যমে।
এছাড়া “শুভদার” কাত্যায়নী কিংবা “আলো-আঁধারের” বিজলির মতো নর্তকীদের মানবিক প্রেমকে পাঠকেরা অত্যন্ত সুন্দর দৃষ্টিতে দেখেছেন। তাদের কাছে প্রেমই সত্য রূপে ধরা দিয়েছে। “গৃহদাহ” এর একদিকে অচলা অন্যদিকে মৃনাল; “চরিত্রহীনের”একদিকে সাবিত্রী অন্যদিকে কিরণময়ী। ভিন্ন মেরুর নারীদের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারকে তুলে ধরেছেন। “বিন্দুর ছেলে” উপন্যাসে বিন্দুবাসিনীর সাথে তার জারজ সন্তানকে নিয়ে এক জটিলতার কাহিনী উপস্থাপন করেছেন শরৎচন্দ্র। এখানে বিন্দুই পুরো উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু।
ঋতুপর্ণের দ্বিতীয় ছবি “উনিশে এপ্রিল” এ মা-মেয়ের মধ্যে বহু বছরের মনঃস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের বিষয়টি উঠে এসেছে। এরপর “দহন” এ ঋতুপর্ণ তুলে ধরেছেন রাস্তার বখাটেদের হাতে একটি তরুণীর শারীরিকভাবে নির্যাতিত হওয়ার গল্প এবং প্রত্যক্ষদর্শী আরেক নারীর প্রতিবাদী আওয়াজ এবং নির্যাতিতার পরিবারের ঔদাসিন্যে প্রত্যক্ষদর্শী নারীর সমাজ নিয়ে হতাশার চিত্র। তার “বাড়িওয়ালী” সিনেমায় উঠে এসেছে একজন মাঝবয়সী নারীর একাকিত্বের গল্প এবং একজন চলচ্চিত্র পরিচালককে ঘিরে তার মনের গোপন বাসনার কথা। তার “দোসর” সিনেমায় তিনি দেখিয়েছন একটি স্ত্রীর মনঃস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনের অবস্থা। “উৎসব” সিনেমায় ঋতুপর্ণ তুলে ধরেছেন একটি বাড়িতে একজন প্রবীণ নারীর থাকা ও তাকে ঘিরে পারিবারিক ভাঙনের গল্প। এভাবেই তিনি তার কাজে ফুটিয়ে তুলেছেন হাল আমলের নারীদের মানসিক জটিলতা।
তাঁরা মূলত মানুষের মনুষ্যত্বকে বড় করে দেখেছেন। তাঁদের দুজনের কাজেই প্রচলিত সমাজনীতি, বৈষম্যের বিরুদ্ধে নারীদের এক বলিষ্ঠ প্রতিবাদ লক্ষ করা যায়। এখানে কার উপর কার প্রভাব রয়েছে সে বিতর্কে না গিয়ে তারা প্রত্যেকেই তাদের সৃষ্টিতে একেকটি নক্ষত্র হয়ে রয়েছেন দর্শক, পাঠকদের মনে।
বিষয়টি নিয়ে আলোচনা