জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ । এই প্রবাদটা হয়ত আমরা কেবল শুনেছি কিন্তু রোহীঙ্গা নামের জাতীগোষ্ঠিটি এই প্রবাদের বাস্তবতা টের পেয়েছিল,পাচ্ছে এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের বিবেক না জাগলে পেতে থাকবে অনাগত ভবিষ্যতেও । কিন্তু এরকম ছিল না রোহিঙ্গা ইতিহাস। নিজ গৃহে প্রবাসী হওয়ার অবস্থা তাদের ছিল না, তারাও স্বাধীন ছিল একদিন।
একথা প্রচলিত আছে যে অষ্টম বা নবম শতকে একটি এরাবিয়ান জাহাজ মিয়ানমার উপকূলে ডুবে যায় এবং সেখান থেকে বেঁচে যাওয়া কিছু নারী পুরুষ আশ্রয় নেয় সেখানে । আল্লাহর “রহমতে” বেঁচে গিয়েছিল বলে নাম হয় রোহিঙ্গা । তবে এটা নিছকই উপকথা । আসলে আরব বনিকরা ব্যবসার উদ্দেশ্যে ও ধর্মপ্রচার করতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে জড়ো হত । স্থানীয় মহিলাদের বিবাহ করে স্থায়ী হয়ে যেত। রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয় নি। বাইরে থেকে আসা আর্যরা যুগ যুগ ধরে বসবাসের ফলে যদি হিন্দুস্থানের অধিবাসী হয় তাহলে রোহিঙ্গারা কেন নয়? তারাও তো যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছে। তাদের পিতামহ এবং তারও প্রপিতামহ হয়ত তারও পুর্বপুরুষদের সময় থেকে। মহাকবি আলাওলের লেখনিতে যে “রোসাঙ্গা” শহরের উল্লেখ পাওয়া যায় তাই এই রোহিঙ্গাদের রাজ্য । ১৪ শ শতকে আমরা তাদের ২২ হাজার বর্গ কিমির একটি স্বাধীন রাজ্যের কথা জানতে পারি। মানে রোহিঙ্গারা “বানের জলে ভেসে আসা উদ্বাস্তু” নয়। তাদের ছিল নিজস্ব জনগোষ্ঠী, ছিল সরকার,নির্দিষ্ট ভূমি এবং সার্বভৌমত্ব।
১৭৮৫ সালে বার্মিজ রাজা বোদাওয়াই আগ্রাসন চালিয়ে দখল করে নেন এই রাজ্য। এখন রাখাইন বা আরাকান যার নাম। বার্মিজ-মগদের স্বভাব আমরা জানি। গনহত্যার স্বীকার হতে থাকে রোহিঙ্গারা। প্রায় ৩০০০ রোহিঙ্গা পালিয়ে আশ্রয় নেয় বাংলাদেশের ভূখন্ডে। ওরা ইংরেজদের আমল থেকে আরো বেশী নিগৃহীত হতে থাকে।
মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় মদদে বেীদ্ধ সন্ত্রাসীরা আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের পৈতৃক ভিটামাটি বাড়িঘর
মিয়ানমারের বর্ণবাদী সরকারের এসময়ের জরিপে সব জাতীগোষ্ঠী এমন কি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোকেও তালিকায় রাখা হলেও রাখা হয় নি রোহিঙ্গাদের। ইংরেজরা যাওয়ার পর এবং মায়ানমারের সামরিক জান্তা ১৯৬২ সালে ক্ষমতা হস্তান্তর করার আগে রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার ছিল, ছিল নাগরিকত্বও। কিন্তু সামরিক সরকার ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর থেকেই আজাব নেমে আসে অসহায় রোহিঙ্গাদের উপর, যার পরের ইতিহাস আমাদের সকলেরই জানা।
আমরা বাংলাদেশীরা তাদের পুশ ব্যাক করছি । চীন মুখে কূলুপ আটবে এটাই স্বাভাবিক কারন মায়ানমার তার বিশাল অস্ত্রের বাজার। আমেরিকার এ অঞ্চলে চাই মিত্র কারন অং সাং সূচি এখানে “আমেরিকান ডেমোক্রেসি ” প্রতিষ্ঠা করছে। আরব বাদশাদের স্বর্ন দেয়াল ভেদ করে এখনো রোহিঙ্গাদের আর্তনাদ পৌঁছায় নি। কথায় কথায় ইসলাম আর মুসলিম ভ্রাতৃত্বের দোহাই দেয়া পাকিস্তান তাদের উৎপাদিত জেএফ ১৭ থান্ডার বিমান বিক্রি কনফার্ম করেছে মায়ানমারের কাছে। এর আগেও তাদের বন্দরে মায়ানমারের নৌ বাহিনী সাবমেরিন ট্রেনিং নিয়েছে শোনা যাচ্ছে। আবার সম্প্রতি ঘটা সেনা বিদ্রোহে নাজুক এরদোয়াগানের তুরস্ক ইজরায়েলের দাবানলে উদ্ধার কর্মী ও বিমান পাঠালেও রোহিঙ্গা বিষয়ে একদম চুপ। মোট কথায় নিজ গৃহে প্রবাসী হওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য পৃথিবী একেবারেই সংকীর্ন হয়ে গেছে অথচ তারাও বলার অধিকার রাখে “আমরাও স্বাধীন, কারন আমরা স্বাধীন ছিলাম।” কারণ ইতিহাস রোহিঙ্গাদের কথা বলছে। কারণ ইতিহাস রোহিঙ্গাদের সমৃদ্ধ অতীতের কথা বলছে।
আজ যে জুলুম রোহিঙ্গাদের উপর করা হচ্ছে তা বন্ধ হোক। মানবতার বিজয় হোক। রোহিঙ্গাদের উপর চলমান বার্মা সন্ত্রাসবাদ বন্ধ না হলে বিশ্ব বিবেক ও মানবতার পরাজয় ঘটবে। সেটা কার্যত সমগ্র মানবজাতিরই পরাজয়। একবিংশ শতাব্দীতে কোটি কোটি মানুষের চোখের সামনে একটি জাতি গণহত্যায় নিঃশেষ হয়ে যাবে সেটি কখনোই মানুষের ইতিহাসে গেীরব করার মত কিছু না। আজকে আমার আপনার নিরবতাই কালকের ইতিহাসে আর্তনাদ করে উপহাস করবে। রোহিঙ্গাদের বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত ও নিরাপদ হবে এই হোক আমাদের সকলের কামনা।
লেখকঃ হুমায়ের জিদান
তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ৪৪ তম আবর্তনের শিক্ষার্থী।
বিষয়টি নিয়ে আলোচনা